ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘বিটকয়েন’ (bitcoin) এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। গত ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে বিটকয়েন ফাউন্ডেশনের সদস্যপদ পেয়েছে। কিন্তু বিটকয়েন কি, কিসের জন্য? কি কাজে প্রয়োজন?
সাধারণত কাগজের তৈরি প্রচলিত মুদ্রা বা এ সংশ্লিষ্ট কোন ডিজিটাল স্বাক্ষর সম্বলিত বস্তু ব্যবহার করে বাস্তব জীবনে এবং অনলাইনে লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো আপাতঃ দৃষ্টিতে কোন প্রকারের সমস্যা ছাড়াই মিটিয়ে ফেলা যায়। তবে বর্তমানে ব্যবহৃত এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড অথবা অন্য ডিজিটাল স্বাক্ষর সম্বলিত বস্তুগুলো ব্যবহারে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে।
এসবে লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহক ও গ্রহিতা উভয়কে তৃতীয় কোন পক্ষের উপর ‘ট্রাস্ট’ বা আস্থা রাখতে হয়, উদাহরণস্বরূপ ব্যাংক। তৃতীয় পক্ষ এই ব্যাংকে উভয় পক্ষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের মুদ্রা পরিশোধ করে, যেটিকে ইংরেজীতে বলে ‘ডাবল স্পেন্ডিং’।
বিটকয়েনের উৎপত্তি
উপরোক্ত সমস্যার সমাধানে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামে একব্যক্তি ২০০৮ সালের অক্টোবার মাসে ৯ পৃষ্ঠার “Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System” নামক এক গবেষণা প্রস্তাবনা অনলাইনে প্রকাশ করে। যেখানে প্রথম বিটকয়েন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপে বলা হয়, একটি পিয়ার-টু-পিয়ার (peer-to-peer) ইলেক্ট্রনিক মুদ্রা পরিশোধের ব্যবস্থা প্রয়োজন, যেটির মাধ্যমে একজন অন্যজনকে কোন তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে না গিয়েই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবে। একই সঙ্গে ‘ডাবল স্পেন্ডিং’ থেকে বিরত থাকতে পারবে। এই ব্যবস্থায় সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন হবে আস্থার পরিবর্তে ‘কাজের (লেনদেন) প্রমাণের’ ভিত্তিতে এবং সব ধরনের লেনদেন একটি নিদিষ্ট নেটওয়ার্কে লিপিবদ্ধ হবে।
প্রস্তাবনা প্রকাশের পর থেকে সাতোশি বিটকয়েন ‘মাইনিং’ এর জন্য প্রথম সফটওয়্যার তৈরি করে। ‘মাইনিং’ হচ্ছে যে পদ্ধতিতে বিটকয়েন তৈরি করা হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সাতোশি প্রথম বিটকয়েন মুদ্রা রিলিজ করে।
এই সাতোশি নাকামোতোর আসল পরিচয় আজও অজানা।
বিটকয়েন কি?
সুতরাং ‘Bitcoin’ – ইংরেজীতে B, ক্যাপিটাল লেটারে– হচ্ছে একটি পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক যেখানে আস্থাভাজন তৃতীয় পক্ষ ছাড়াই মুদ্রার মালিকানা পরিবর্তন সম্ভব, আর এই নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত একক হচ্ছে ‘bitcoin’- ইংরেজীতে b, স্মল লেটারে – যেটি সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল উপায়ে ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে কম্পিটার কোডিং ব্যবহার করে তৈরি হয়।
বিটকয়েনের বৈশিষ্ট্য
সম্পূর্ণ ডিজিটাল উপায়ে তৈরি, বাস্তবে এটির কোন ফিজিক্যাল (physical) অস্তিত্ব নেই। কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি নিয়ন্ত্রণ করেনা। ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী এটি ব্যবহারের ফলে এর মুদ্রা ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। পিয়ার-টু-পিয়ার ব্যবস্থার কারণে কোন প্রতিষ্ঠান বা মিডলম্যান ছাড়াই সরাসরি লেনদেন সম্পন্ন হয়। ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হওয়ার কারণে উপযুক্ত অনুমতি ছাড়া বিটকয়েনের অ্যাকসেস নেওয়া অসম্ভব। সর্বোপরি, বিটকয়েনে সম্পূর্ণরূপে ছদ্দনামে লেনদেন সম্ভব।
প্রচলিত মুদ্রা এবং বিটকয়েনের মধ্যে পার্থক্য
পৃথিবীব্যাপী ব্যবহৃত প্রচলিত মুদ্রাগুলো মূলত কাগজের তৈরি। যেকোন প্রকারের সেবা আদান-প্রদানের হিসাব নিকাশের মূলে থাকে কাগজের তৈরি মুদ্রা। যে উপায়েই সেবা আদান-প্রদানের করা হোকনা কেন, মুখোমুখি সেবা দেওয়া-নেওয়া, অনলাইনে সেবা দেওয়া-নেওয়া, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা আদান-প্রদান ইত্যাদি।
ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে তৈরি করা বিটকয়েন একধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি। প্রচলিত মুদ্রা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যকার প্রধান পার্থক্য হলো- ফিজিক্যাল অস্তিত্বের কারণে প্রচলিত মুদ্রা হাতে হাতে ব্যবহার করা যায়, হাতে নেওয়া যায়। অন্যদিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি শুধু ব্যবহার করা যায়। ভার্চুয়াল অথবা ডিজিটাল হওয়ার কারণে এটি শুধু ব্যবহার করা যায়,কখনো হাতে নেওয়া সম্ভব নয়।
বিটকয়েন যেভাবে কাজ করে
পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্ক হওয়ার কারণে বিটকয়েনের ট্রানজিকশন বা লেনদেন সেবা দাতা ও গ্রহিতার ‘ওয়ালেট’ থেকে ‘ওয়ালেটে’ সম্পন্ন হয়। ‘ওয়ালেটে’ বিটকয়েন সঞ্চিত রাখা থাকে। এটি অনলাইন বা অফলাইন দু’রকমেই হতে পারে। একজন বিটকয়েন ব্যবহারকারীকে দুটি ‘কি’ (Keys) ব্যবহার করতে হয়। একটি ‘পাবলিক কি’ (Public Key), এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। অন্যটি ‘প্রাইভেট কি’ (Private key), এটি সর্বদা গোপন থাকে এবং লেনদেনের নিশ্চয়তার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ট্রানজিকশনের ইতিবৃত্ত একটি উম্মুক্ত খতিয়ানে (পাবলিক লেজার) রেকর্ড করা থাকে, যাকে ‘ব্লক চেইন’ (Block chain) বলে। এক্ষেত্রে ‘পাবলিক কি’ ব্যবহার করা হয় এবং একই লেনদেন একই ব্যবহারকারীর মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি করা যায়না। ব্লকচেইনে সর্বপ্রথম ট্রানজিকশনের হিসাব থেকে আজ পর্যন্ত সব হিসাব সংরক্ষিত আছে এবং নিয়মিতভাবে আপডেট হচ্ছে।
বিটকয়েনের অপকারিতা
তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ লেখক কেন হাসের মতে, বিটকয়েনের কয়েকটি অপকারিতা রয়েছে। প্রথমতঃ লেনদেন পুনরাবৃত্তি না করতে পারার কারণে, সেবা গ্রহিতা সংশ্লিষ্ট সেবা না পেলে, মুদ্রা ফেরত পাওয়ার কোন উপায় নেই। দ্বিতীয়তঃ বিটকয়েন ‘ওয়ালেট’ হারিয়ে বা নষ্ট (ড্যামেজ) হয়ে গেলে এটি আর ফিরে পাওয়া যায়না। যেটি আমাদের ব্যবহৃত মানিব্যাগ বা মুদ্রার ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়।
তৃতীয়তঃ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিটকয়েন খুব বেশি অস্থিতিশীল।
চতুর্থতঃ যদিও বিটকয়েনর ব্যবহার ক্রমান্নয়ে বাড়ছে, কিন্ত সেটি প্রচলিত মুদ্রার তুলনায় খুবিই সীমিত পরিসরে। সুতরাং এটিকে প্রচলিত মুদ্রায় পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে হয়। সর্বোপরি, বিটকয়েনে কোন ক্রেডিট ব্যবস্থা নেই। যদিও এটি একটি ভাল দিক, কিন্ত বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি চলছে ক্রেডিট নির্ভর। ক্রেডিটের উপর ভিত্তি করে আমরা অগ্রীম সেবা নিয়ে থাকি।
বিটকয়েনের প্রতিদ্বন্দ্বী
বর্তমানে ৪৫৪ রকমের ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশ্বব্যাপী কমবেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে Litecoin এবং Ripple অন্যতম। অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো বিটকয়েনের মত এতটা ব্যবহৃত হয়না। আপাতদৃষ্টিতে Litecoin-কে বিটকয়েনের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হলেও, এটির সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।
বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড/কোম্পানি যারা বিটকয়েন নেন
বাস্তব জগতে বিটকয়েন এর বিনিময়ে প্রথম কোন পণ্য কেনা হয় ২০১০ সালের ২১ মে, যখন বিটকয়েন ব্যবহারকারী লাসজলো (Laszlo) ১০ হাজার বিটকয়েন মুদ্রার বিনিময়ে ২৫ ডলার মুল্যের একটি পিৎ’জা কেনেন।
বিশ্বব্যাপী ৩০ হাজার এর বেশি ব্যবসায়ী এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান বিটকয়েন নেন। মার্কিন শেয়ারবাজার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নাসদাকের তথ্যমতে, ইউএস ভিত্তিক অনলাইন খুচরা বিক্রেতা Overstock.com, ইউকে ভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্রায়ানসন পরিচালিত বিমান সেবা প্রতিষ্ঠান Virgin Galactic, জনপ্রিয় বিনামূল্যে ব্লগিং প্লাটফরম Wordpress, জনপ্রিয় মোবাইল গেইমিং কোম্পানি Zynga, আন্তর্জাতিক ই-কমারস পেমেন্টস ওয়েবসাইট PayPal, অ্যামেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান Tesla Motors, অনলাইন ডেটিং ওয়েবসাইট OkCupid, এবং জনপ্রিয় টরেন্ট সাইট The Pirate Bay বিটকয়েনের মাধ্যমের তাদের সেবা আদান-প্রদান করে থাকে।
No comments:
Post a Comment