সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ
তথ্যপ্রযুক্তি জগতে বাড়ছে ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিং
তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়নের এই যুগে কাজের পরিধি এখন নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত। দেশে বসে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে বৈশ্বিক কাজের বাজার চষে বেড়ানোর ক্ষেত্রে পরিচিত একটি নাম আউটসোর্সিং। বাংলাদেশে আউটসোর্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে আউটসোর্সিং খাতের পরিধি। চলতি বছরের মার্চ মাসে আউটসোর্সিং বিষয়ক ওয়েবসাইট ওডেস্ক ফ্রিল্যান্সিং কাজের ভিত্তিতে একটি র্যাংকিং প্রকাশ করে। উক্ত র্যাংকিং ঢাকা ৩য় স্থানে অবস্থান করে। আউটসোর্সিং খাতের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটলে এটি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানতম খাতে পরিণত হতে পারে। দেশে আউটসোর্সিং-এর সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন মোজাহেদুল ইসলাম ঢেউ
তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়নের এই যুগে কাজের ক্ষেত্র বর্তমানে নিজ দেশ কিংবা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কাজের ক্ষেত্র এখন বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত। স্বল্পউন্নত, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বিশ্বে দক্ষ, আধাদক্ষ এমনকি অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সংস্কৃতি চালু রয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়, কারণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে প্রবাসে কর্মরতদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। তবে বর্তমানে বিদেশে গিয়ে দৈহিক পরিশ্রম করেই যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে এমন নয়। তথ্যপ্রযুক্তির জয়জয়কার এই যুগে দেশে বসেই প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে আউটসোর্সিং। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী কোন কাজ করাকে সাধারণত আউটসোর্সিং বলা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্স কর্মীদের জন্য অনলাইনে কাজের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফ্রিল্যান্সার ডট কম। ২০০৪ সালে সাইটটি যাত্রা শুরু করে। অস্ট্রেলিয়া থেকে পরিচালিত এবং প্রতিষ্ঠিত এই সাইটটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম আউটসোর্সিং মার্কেট পেস্নসে পরিণত হয়েছে। ফ্রিল্যান্সার ডটকমের প্রধান নির্বাহী মাত ব্যারী বলেছেন, 'আউটসোর্সিং ব্যবসা যে কেউ যে কোন স্থান থেকে করতে পারে। স্বল্পতম সময়ে এই সাইটে কাজ পোস্ট করা যায়। যোগ্য ফ্রিল্যান্সাররা এই কাজ রিসিভ করে সম্পন্ন করতে পারে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার ডট কো ডট এনজেড নামে একটি নতুন সাইট চালু হয়েছে, যা নিউজিল্যান্ড থেকে পরিচালিত হচ্ছে।' নিউজিল্যান্ডে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্স কাজের পরিধি দিন দিন সমৃদ্ধতর হচ্ছে। নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সাররা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং এর কাজ করছে। এসবের মধ্যে আইটি, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল ফোন এবং আইপ্যাড অ্যাপিস্নকেশন ডেভেলপমেন্ট, কনটেন্ট তৈরি, ডিজাইন এবং আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান, সেলস এবং মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন ধরনের কাজ হচ্ছে ব্যারী আরে বলেন, 'ফ্রিল্যান্সার ডট কমে পোস্টকৃত প্রতিটি কাজে গড়ে প্রায় ৪০টি বিড (নিলাম ডাক) হয়ে থাকে। কোন কোন সময় এর পরিমাণ ৫০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সাইটটির নূন্যতম প্রজেক্ট মূল্য হচ্ছে ৩০ ডলার এবং যেখানে গড় বিড মূল্য হচ্ছে ২০০ ডলার। ফ্রিল্যান্সার ডট কমে প্রায় ১৫ লাখ নিবন্ধনকৃত গ্রাহক রয়েছে। এই সাইটের বেশিরভাগ কাজ আসে আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। নিলামে অংশগ্রহণকারী (বিডার) বেশিরভাগ হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের। তাছাড়া অন্যান্য দেশের কিছু থাকে। সাইটটির পোস্ট হওয়া ৯০ ভাগ কাজ করে থাকে সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের ফ্রিল্যান্সাররা। ফ্রিল্যান্সার ডট কম মাত্র এক বছর আগেও বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব সাইটগুলোর তালিকায় পাঁচহাজার তম অবস্থানে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সাইটটি সেরা চারশোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
আউটসোর্সিং-এ সম্ভাবনাময় দেশের কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের মার্চ মাসে বিশ্বখ্যাত আউটসোর্সিং সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠান ওডেস্কের এক র্যাংকিং-এ আউটসোর্সিং-এ ঢাকার অবস্থান ছিল তিন নম্বর। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারদের কর্মপ্রচেষ্টায় র্যাংকিং-এর শীর্ষ তিনে উঠে আসে ঢাকার নাম। ঢাকা ইতোমধ্যেই আউটসোর্সিং-এ বিশ্বের সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে আউটসোর্সিং-এ আমাদের যতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেনি। এর মধ্যে অন্যতম ঘাটতি রয়েছে সংশিস্নষ্ট ক্ষেত্রে সচেতনতার বিষয়ে। ওডেস্কের এক তথ্য মতে ঢাকার এ সফলতার পেছনে রয়েছে সস্তা শ্রম এবং ইংরেজিতে দক্ষতার বিষয়টি। ঢাকার ফ্রিল্যান্সাররা আউটসোর্সিং-এ ওডেস্কের মাধ্যমে যেসব কাজ বেশি করে থাকে তার মধ্যে হচ্ছে- গ্রাফিক ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি এবং চেকআপ, অনুবাদ এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্ট। ওডেস্কে আউটসোর্সিং-এ শীর্ষ শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের চন্ডিগড় এবং মোহালী, ঢাকা এবং ফিলিপাইনের লোকজন শহর। তবে ঢাকার অর্ধেক ফ্রিল্যান্সার ডাটা এন্ট্রির কাজ করে থাকে। ফিলিপাইন এবং আমেরিকার এক রিপোর্ট অনুসারে ভারত হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আউটসোর্সিং করা দেশ। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বর্তমানে গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং ডাটা এন্ট্রির কাজ করে প্রতিমাসে প্রায় এক হাজার ডলারের মতো আয় করে থাকে।
দেশে দিন দিন বেড়েই চলছে আউটসোর্সিং কাজের পরিধি। কয়েক বছর আগেও আউটসোর্সিং-এর বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম ছিল না। সেখানে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, সুলভমূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব হলে দ্রুত সমৃদ্ধ হবে আমাদের আউটসোর্সিং সংস্কৃতি। ভারতে এমনকি আমাদের দেশের ছাত্ররাও আউটসোর্সিং কাজ করছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীর জন্য পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধার সুযোগ নেই। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নেই ইন্টারনেট সংযোগ। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা, বিদু্যৎসহ সংশিস্নষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানমত খাতে পরিণত হতে পারে আউটসোর্সিং খাত।
আউটসোর্সিং-এর রকমফের
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিং রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও), কো-সোর্সিং, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রসেস আউটসোর্সিং (ইপিও), ফার্মশোরিং, হোমশোরিং, ইনসোর্সিং, নলেজ প্রসেস আউটসোর্সিং (কেপিও), লিগ্যাল প্রসেস আউটসোর্সিং (এলজিও), নিয়ারশেরিং, ইনফরমেশন টেকনোলজি আউটসোর্সিং, অফশোর আউটসোর্সিং, অফশোর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অফশোরিং আইটি সার্ভিসেস, প্রিন্ট এন্ড মেইল আউটসোর্সিং, রিক্রুট প্রসেস, আউটসোর্সিং, স্যোশিয়ালি রেসপন্সিবল আউটসোর্সিং।
বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং কাজের ক্ষেত্র
ফ্রিল্যান্সার ডট কম, ওডেস্কসহ অন্য যে কোন আউটসোর্সিং বিষয়ক ওয়েব সাইটে ঢুকলে দেখা যায় বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কাজের ছড়াছড়ি। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এত বেশি কাজের অফার রয়েছে যে আপনি কোনটা ছেড়ে কোনটা করবেন। তবে সংশিস্নষ্ট কাজের দক্ষতা থাকা চাই। আউটসোর্সিং-এ বিশ্বখ্যাত কয়েকটি ওয়েব সাইটে প্রদর্শিত কাজের শিরোনাম থেকে এখানে কিছু উলেস্নখ করা হলো।
ওয়েবসাইট, আইটি এবং সফটওয়্যার : ওয়েবসাইট, আইটি এবং সফটওয়্যার বিষয়ক কাজ রয়েছে এখানে। সংশিস্নষ্ট বিষয়ের কাজ জানা কর্মীরা এখানে প্রায় ১৫০ ধরনের আলাদা আলাদা কাজের সন্ধান পাবেন।
মোবাইল ফোন এন্ড কম্পিউটিং : মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটিং বিষয়ে পারদর্শীরা এখান থেকে কাজ নিতে পারেন। এখানে ফ্রিল্যান্সাররা ১৫ ধরনের কাজের সুযোগ পাবেন।
রাইটিং এন্ড কনটেন্ট : যারা লেখালেখিতে বেশ দক্ষ, তারা এখানে কাজ পেতে পারেন। এখানে ৩৫ ধরনের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লেখার কাজ পাওয়া যায়।
ডিজাইন, মিডিয়া এন্ড আর্কিটেকচার : আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সাররা ডিজাইনের কাজ অনেক বেশি পরিমাণে করে থাকে। এখানে সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর প্রায় ৫৫ ধরনের কাজ পাওয়া যায।
ডাটা এন্টি : বাংলাদেশে আউটসোর্সিং জগতে সবচেয়ে বেশি হয় ডাটা এন্ট্রির কাজ। এখানে ডাটা এন্টি সংক্রান্ত ১৫ ধরনের কাজ পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অনুযায়ী আপনিও কাজ করতে পারেন এখানে।
ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স : ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান বিষয়ক কাজের ক্ষেত্র এটি। এখানের কাজের মধ্যে রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর দক্ষতা অনুযায়ী এখানে প্রায় ৪৫ ধরনের কাজ পাওয়া যেতে পারে।
প্রোডাক্ট সোর্সিং এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং : এখানে কাজের পরিধি কিছুটা সীমিত। পণ্যের উৎপাদন বিষয়ক বিভিন্ন কাজ থাকে এখানে। প্রায় ৬ ধরনের কাজ পাওয়া যায় এখানে।
সেলস এন্ড মার্কেটিং : সেলস এন্ড মার্কেটিং ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দিন দিন বাড়ছে এই খাতের পরিধি। এখানে সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর ১৬ ধরনের কাজ পাওয়া যায়।
বিজনেস, অ্যাকাউন্টিং, হিউম্যান রিসোর্স এন্ড লিগ্যাল : ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আইন সংক্রান্ত বিষয়ের কাজ পাওয়া যায় এখানে। সংশিস্নষ্ট ক্ষেত্রের প্রায় ৩০ ধরনের কাজ পাওয়া যায় এখানে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়ে রয়েছে অনেক কাজ। আপনি চাইলে সরাসরি ওয়েব সাইটে ঢুকে এসব কাজ বিস্তারিতভাবে দেখতে পারেন।
আউটসোর্সিং সংক্রান্ত কিছু শব্দ সংক্ষেপ : এভিএল (অ্যাপ্রোভড ভেন্ডর লিস্ট), বিওএম (বিল অব ম্যাটেরিয়ালস), সিএআর (আরেক্টিভ অ্যাকশন রিকোয়েস্ট), ডিএফএম (ডিজাইন ফর ম্যানুফ্যাকচারিং), ডিএফটি (ডিজাইন ফর টেস্ট), ইএমএস (ইলেক্ট্রনিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভিসেস), ইসিও (ইঞ্জিনিয়ারিং চান্স অর্ডার), এফপিওয়াই (ফার্স্ট-পাস ইয়েল্ড), আইপি (ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি), জেডিএম (জায়েন্ট ডিজাইন ম্যানুফ্যাকচারার), জেএসএ (জয়েন্ট সার্ভিস এগ্রিমেন্ট), এমএসএ (ম্যানুফাংচারিং এন্ড সাপস্নাই ম্যানেজমেন্ট), এনআরই (নিউ প্রোডাক্ট ইন্ট্রোডাকশন), ওডিএম (অরিজিন্যাল ডিজাইন ম্যানুফেকচারার), ওইএম (অরিজিন্যাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার), পিপিএন্ডই (পস্নান্টস, প্রোপার্টি এন্ড ইকুইপমেন্ট), আরইকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোট), আরওআইসি (রিটার্ন অন ইনভেসটেড ক্যাপিটাল), টিটিএম (টাইম টু মার্কেট), টিটিভি (টাইম টু ভলিউম), ভিএমআই (ভেন্ডর ম্যানেজড ইনভেন্টরী), ভিপিএ (ভলিউম প্রাইস এগ্রিমেন্ট)।
Source: Daily Ittefaq
তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বায়নের এই যুগে কাজের ক্ষেত্র বর্তমানে নিজ দেশ কিংবা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কাজের ক্ষেত্র এখন বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত। স্বল্পউন্নত, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত বিশ্বে দক্ষ, আধাদক্ষ এমনকি অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সংস্কৃতি চালু রয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়, কারণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ আসে প্রবাসে কর্মরতদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। তবে বর্তমানে বিদেশে গিয়ে দৈহিক পরিশ্রম করেই যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে এমন নয়। তথ্যপ্রযুক্তির জয়জয়কার এই যুগে দেশে বসেই প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে আউটসোর্সিং। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী কোন কাজ করাকে সাধারণত আউটসোর্সিং বলা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী ফ্রিল্যান্স কর্মীদের জন্য অনলাইনে কাজের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফ্রিল্যান্সার ডট কম। ২০০৪ সালে সাইটটি যাত্রা শুরু করে। অস্ট্রেলিয়া থেকে পরিচালিত এবং প্রতিষ্ঠিত এই সাইটটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম আউটসোর্সিং মার্কেট পেস্নসে পরিণত হয়েছে। ফ্রিল্যান্সার ডটকমের প্রধান নির্বাহী মাত ব্যারী বলেছেন, 'আউটসোর্সিং ব্যবসা যে কেউ যে কোন স্থান থেকে করতে পারে। স্বল্পতম সময়ে এই সাইটে কাজ পোস্ট করা যায়। যোগ্য ফ্রিল্যান্সাররা এই কাজ রিসিভ করে সম্পন্ন করতে পারে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার ডট কো ডট এনজেড নামে একটি নতুন সাইট চালু হয়েছে, যা নিউজিল্যান্ড থেকে পরিচালিত হচ্ছে।' নিউজিল্যান্ডে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্স কাজের পরিধি দিন দিন সমৃদ্ধতর হচ্ছে। নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সাররা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং এর কাজ করছে। এসবের মধ্যে আইটি, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, মোবাইল ফোন এবং আইপ্যাড অ্যাপিস্নকেশন ডেভেলপমেন্ট, কনটেন্ট তৈরি, ডিজাইন এবং আর্কিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান, সেলস এবং মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন ধরনের কাজ হচ্ছে ব্যারী আরে বলেন, 'ফ্রিল্যান্সার ডট কমে পোস্টকৃত প্রতিটি কাজে গড়ে প্রায় ৪০টি বিড (নিলাম ডাক) হয়ে থাকে। কোন কোন সময় এর পরিমাণ ৫০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সাইটটির নূন্যতম প্রজেক্ট মূল্য হচ্ছে ৩০ ডলার এবং যেখানে গড় বিড মূল্য হচ্ছে ২০০ ডলার। ফ্রিল্যান্সার ডট কমে প্রায় ১৫ লাখ নিবন্ধনকৃত গ্রাহক রয়েছে। এই সাইটের বেশিরভাগ কাজ আসে আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। নিলামে অংশগ্রহণকারী (বিডার) বেশিরভাগ হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের। তাছাড়া অন্যান্য দেশের কিছু থাকে। সাইটটির পোস্ট হওয়া ৯০ ভাগ কাজ করে থাকে সাধারণত উন্নয়নশীল দেশের ফ্রিল্যান্সাররা। ফ্রিল্যান্সার ডট কম মাত্র এক বছর আগেও বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব সাইটগুলোর তালিকায় পাঁচহাজার তম অবস্থানে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সাইটটি সেরা চারশোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
আউটসোর্সিং-এ সম্ভাবনাময় দেশের কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের মার্চ মাসে বিশ্বখ্যাত আউটসোর্সিং সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠান ওডেস্কের এক র্যাংকিং-এ আউটসোর্সিং-এ ঢাকার অবস্থান ছিল তিন নম্বর। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সারদের কর্মপ্রচেষ্টায় র্যাংকিং-এর শীর্ষ তিনে উঠে আসে ঢাকার নাম। ঢাকা ইতোমধ্যেই আউটসোর্সিং-এ বিশ্বের সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে আউটসোর্সিং-এ আমাদের যতটুকু সম্ভাবনা রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটেনি। এর মধ্যে অন্যতম ঘাটতি রয়েছে সংশিস্নষ্ট ক্ষেত্রে সচেতনতার বিষয়ে। ওডেস্কের এক তথ্য মতে ঢাকার এ সফলতার পেছনে রয়েছে সস্তা শ্রম এবং ইংরেজিতে দক্ষতার বিষয়টি। ঢাকার ফ্রিল্যান্সাররা আউটসোর্সিং-এ ওডেস্কের মাধ্যমে যেসব কাজ বেশি করে থাকে তার মধ্যে হচ্ছে- গ্রাফিক ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি এবং চেকআপ, অনুবাদ এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্ট। ওডেস্কে আউটসোর্সিং-এ শীর্ষ শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতের চন্ডিগড় এবং মোহালী, ঢাকা এবং ফিলিপাইনের লোকজন শহর। তবে ঢাকার অর্ধেক ফ্রিল্যান্সার ডাটা এন্ট্রির কাজ করে থাকে। ফিলিপাইন এবং আমেরিকার এক রিপোর্ট অনুসারে ভারত হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আউটসোর্সিং করা দেশ। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বর্তমানে গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং ডাটা এন্ট্রির কাজ করে প্রতিমাসে প্রায় এক হাজার ডলারের মতো আয় করে থাকে।
দেশে দিন দিন বেড়েই চলছে আউটসোর্সিং কাজের পরিধি। কয়েক বছর আগেও আউটসোর্সিং-এর বৈশ্বিক মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম ছিল না। সেখানে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, সুলভমূল্যে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব হলে দ্রুত সমৃদ্ধ হবে আমাদের আউটসোর্সিং সংস্কৃতি। ভারতে এমনকি আমাদের দেশের ছাত্ররাও আউটসোর্সিং কাজ করছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীর জন্য পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধার সুযোগ নেই। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নেই ইন্টারনেট সংযোগ। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা, বিদু্যৎসহ সংশিস্নষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধানমত খাতে পরিণত হতে পারে আউটসোর্সিং খাত।
আউটসোর্সিং-এর রকমফের
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিং রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও), কো-সোর্সিং, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রসেস আউটসোর্সিং (ইপিও), ফার্মশোরিং, হোমশোরিং, ইনসোর্সিং, নলেজ প্রসেস আউটসোর্সিং (কেপিও), লিগ্যাল প্রসেস আউটসোর্সিং (এলজিও), নিয়ারশেরিং, ইনফরমেশন টেকনোলজি আউটসোর্সিং, অফশোর আউটসোর্সিং, অফশোর সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অফশোরিং আইটি সার্ভিসেস, প্রিন্ট এন্ড মেইল আউটসোর্সিং, রিক্রুট প্রসেস, আউটসোর্সিং, স্যোশিয়ালি রেসপন্সিবল আউটসোর্সিং।
বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং কাজের ক্ষেত্র
ফ্রিল্যান্সার ডট কম, ওডেস্কসহ অন্য যে কোন আউটসোর্সিং বিষয়ক ওয়েব সাইটে ঢুকলে দেখা যায় বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কাজের ছড়াছড়ি। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এত বেশি কাজের অফার রয়েছে যে আপনি কোনটা ছেড়ে কোনটা করবেন। তবে সংশিস্নষ্ট কাজের দক্ষতা থাকা চাই। আউটসোর্সিং-এ বিশ্বখ্যাত কয়েকটি ওয়েব সাইটে প্রদর্শিত কাজের শিরোনাম থেকে এখানে কিছু উলেস্নখ করা হলো।
ওয়েবসাইট, আইটি এবং সফটওয়্যার : ওয়েবসাইট, আইটি এবং সফটওয়্যার বিষয়ক কাজ রয়েছে এখানে। সংশিস্নষ্ট বিষয়ের কাজ জানা কর্মীরা এখানে প্রায় ১৫০ ধরনের আলাদা আলাদা কাজের সন্ধান পাবেন।
মোবাইল ফোন এন্ড কম্পিউটিং : মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটিং বিষয়ে পারদর্শীরা এখান থেকে কাজ নিতে পারেন। এখানে ফ্রিল্যান্সাররা ১৫ ধরনের কাজের সুযোগ পাবেন।
রাইটিং এন্ড কনটেন্ট : যারা লেখালেখিতে বেশ দক্ষ, তারা এখানে কাজ পেতে পারেন। এখানে ৩৫ ধরনের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক লেখার কাজ পাওয়া যায়।
ডিজাইন, মিডিয়া এন্ড আর্কিটেকচার : আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সাররা ডিজাইনের কাজ অনেক বেশি পরিমাণে করে থাকে। এখানে সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর প্রায় ৫৫ ধরনের কাজ পাওয়া যায।
ডাটা এন্টি : বাংলাদেশে আউটসোর্সিং জগতে সবচেয়ে বেশি হয় ডাটা এন্ট্রির কাজ। এখানে ডাটা এন্টি সংক্রান্ত ১৫ ধরনের কাজ পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অনুযায়ী আপনিও কাজ করতে পারেন এখানে।
ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স : ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান বিষয়ক কাজের ক্ষেত্র এটি। এখানের কাজের মধ্যে রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর দক্ষতা অনুযায়ী এখানে প্রায় ৪৫ ধরনের কাজ পাওয়া যেতে পারে।
প্রোডাক্ট সোর্সিং এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং : এখানে কাজের পরিধি কিছুটা সীমিত। পণ্যের উৎপাদন বিষয়ক বিভিন্ন কাজ থাকে এখানে। প্রায় ৬ ধরনের কাজ পাওয়া যায় এখানে।
সেলস এন্ড মার্কেটিং : সেলস এন্ড মার্কেটিং ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দিন দিন বাড়ছে এই খাতের পরিধি। এখানে সংশিস্নষ্ট বিষয়ের উপর ১৬ ধরনের কাজ পাওয়া যায়।
বিজনেস, অ্যাকাউন্টিং, হিউম্যান রিসোর্স এন্ড লিগ্যাল : ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আইন সংক্রান্ত বিষয়ের কাজ পাওয়া যায় এখানে। সংশিস্নষ্ট ক্ষেত্রের প্রায় ৩০ ধরনের কাজ পাওয়া যায় এখানে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়ে রয়েছে অনেক কাজ। আপনি চাইলে সরাসরি ওয়েব সাইটে ঢুকে এসব কাজ বিস্তারিতভাবে দেখতে পারেন।
আউটসোর্সিং সংক্রান্ত কিছু শব্দ সংক্ষেপ : এভিএল (অ্যাপ্রোভড ভেন্ডর লিস্ট), বিওএম (বিল অব ম্যাটেরিয়ালস), সিএআর (আরেক্টিভ অ্যাকশন রিকোয়েস্ট), ডিএফএম (ডিজাইন ফর ম্যানুফ্যাকচারিং), ডিএফটি (ডিজাইন ফর টেস্ট), ইএমএস (ইলেক্ট্রনিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভিসেস), ইসিও (ইঞ্জিনিয়ারিং চান্স অর্ডার), এফপিওয়াই (ফার্স্ট-পাস ইয়েল্ড), আইপি (ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টি), জেডিএম (জায়েন্ট ডিজাইন ম্যানুফ্যাকচারার), জেএসএ (জয়েন্ট সার্ভিস এগ্রিমেন্ট), এমএসএ (ম্যানুফাংচারিং এন্ড সাপস্নাই ম্যানেজমেন্ট), এনআরই (নিউ প্রোডাক্ট ইন্ট্রোডাকশন), ওডিএম (অরিজিন্যাল ডিজাইন ম্যানুফেকচারার), ওইএম (অরিজিন্যাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার), পিপিএন্ডই (পস্নান্টস, প্রোপার্টি এন্ড ইকুইপমেন্ট), আরইকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোট), আরওআইসি (রিটার্ন অন ইনভেসটেড ক্যাপিটাল), টিটিএম (টাইম টু মার্কেট), টিটিভি (টাইম টু ভলিউম), ভিএমআই (ভেন্ডর ম্যানেজড ইনভেন্টরী), ভিপিএ (ভলিউম প্রাইস এগ্রিমেন্ট)।
Source: Daily Ittefaq
No comments:
Post a Comment